হাজার বছর সময়টা যে ঠিক কতটা, সেটা হুট করে বুঝতে পারা বা উপলব্ধি করা খুব একটা সহজ নয়। অামরা অাজ যে গল্প বলতে যাচ্ছি, সেটার ক্লাইম্যাক্স ঘটে অাজ থেকে নশো ষাট বছর অাগে, মানে প্রায় হাজার বছরই বলা চলে। এই হাজার বছরে পৃথিবীতে, বিশেষত মানব সভ্যতায় কত কীই না ঘটে গেছে, তার এখন লিষ্টি করতে বসলে হাজার দিন লেগে যাবে, লাগবে হাজার খানেক ঐতিহাসিককে। অতজন ইতিহাসবিদ একসঙ্গে হলে চেতন ভগতের কান দিয়ে স্টীম বেড়িয়ে যাবে, তাই ওদিকে অার না গিয়ে চলুন অামরা পিছিয়ে যাই প্রায় সাড়ে নশো বছর অাগে, ফ্রান্স দেশের নর্মান্ডি এলাকার বায়ো বা বাইয়ু (Bayeux) শহরে গিয়ে একটু বায়ু সেবন করে বায়ো-ডেটা ইমপ্রুভ করে অাসি।
Bayeux Historic Centre by Anton Bielousov
নর্মান কথাটি এসেছে নর্সম্যান থেকে। ভাইকিংরা নর্সদেশ–অধুনা নরওয়ে-সুইডেন–থেকে তাদের লংবোট করে লুটপাট করতে বেরত। খ্রীষ্টাব্দ দশম শতাব্দি নাগাদ ফ্রান্সে এদের জোরজুলুম-মারামারি-কাটাকাটি বেশ বেশি রকম বেড়ে উঠল। শেষে ফরাসি রাজা তৃতীয় চার্লস এবং ভাইকিংরাজ রোলোর মধ্যে চুক্তি হল যে, লুঠতরাজ বন্ধ করে ভাইকিংরা ফ্রান্সের উত্তরদিকে বসবাস করতে শুরু করবে। এদিকে নর্সদেশের ওরিজিনাল ভাইকিংরা অাপত্তি করল, বলল ফরাসি ভাইকিংরা লুটপাট করা ভুলে গেছে, তাদের ভাইকিং বললে ভাইকিংদের অপমান। তাই মিটিং-ফিটিং করে ঠিক হল যে ফরাসি ভাইকিংদের এখন থেকে নর্মান বলা হবে। সকলেই বেশ খুশি হয়ে রাজি-টাজি হয়ে পড়ল, অামাদের গল্পও এগোতে থাকল।
হ্যাঁ তো কী যেন বলছিলুম? ও ইয়েস, নর্মান। তো, নর্মানরা যেখানে বসে পড়ল সে জায়গাকে স্বভাবতই নর্মান্ডি (Normandy) বলা শুরু হল। নর্মান-এ, নর্মান-বি বা নর্মান-সি বাদ দিয়ে নর্মান-ডি কেন, সে নিয়ে ইতিহাস নিশ্চুপ। চেতনদা হয়তো জানবেন। উনি মহাপুরুষ। তো এই নর্মান্ডিকে দেখতে খানিকটা বাঁদিকে, মানে পশ্চিমদিকে, মুখ ফেরানো লেজউঁচু হাসের মত, নর্মান্ডিম পাড়লো বলে, দেখলেই মনে এক্ষুনি প্যাঁক-প্যাঁক করতে করতে ছানাপোনা সুদ্ধু ইংলিশ চ্যানেলে নেমে যাবে। সেই নর্মানডাকের ঘাড়ের কাছে হইল গিয়া অামাদের সেই বায়ো বা বাইয়ু শহর। রোমান সাম্রাজ্যের সময় যার নাম ছিল অগাস্টোডিয়ুরাম। কেল্টিক ভাষায় ডুরো বা ওয়েল্শ-ব্রেটন ভাষায় ডোর মানে গেট বা দরজা। রোমান সম্রাট অগাস্টাসের সন্মানে এই নাম। বায়ো শহরের অন্যতম ঐতিহাসিক অাকর্ষণ বায়ো ক্যাথিড্রাল, যেখানে এককালে ঝোলানো থাকত অামাদের এই প্রাককথনের প্রধান চরিত্র, বায়ো টেপেস্ট্রী (Bayeux Tapestry)।
A detail from the Bayeux Tapestry showing Odo, half brother to William the Great, cheering his troops forward. From Wikimedia.
লম্বায়, ৭০ মিটার, প্রায় অাড়াইশো ফুট। চওড়ায়, অাধা মিটার, দেড় ফুটের একটু বেশি। লিনেন কাপড়ের উপর রংচঙে উল দিয়া বোনা এই টেপেস্ট্রীটার প্রথম লিখিত উল্লেখ পাওয়া যায় খ্রীষ্টাব্দ ১৪৭৬ সালে বায়ো ক্যাথিড্রালের একটি নথিতে। এটি তৈরি হয় খুব সম্ভবত ১০৭০-১০৯০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে, অার্ল অফ কেন্টের বিশপ ওডোর নির্দেশে। বিশপ ওডো ছিলেন নর্মান্ডির ডিউক উইলিয়ামের বৈমাত্রেয় ভাই। ইতিহাসের পাতায় উইলিয়ামের প্রধান পরিচয় অবিশ্যি ইংল্যান্ডের প্রথম নর্মান রাজা উইলিয়াম দ্য কঙ্কারার হিসাবে। হ্যারোল্ড গডউইনসনকে যিনি ১০৬৬ সালে হেস্টিঙ্গসের যুদ্ধে হারিয়ে সিংহাসন লাভ করেছিলেন। বায়ো টেপেস্ট্রীতে এই যুদ্ধেরই বিবরণ অতি যত্নে সুন্দর করে দেওয়া অাছে। এর দুই ধারে অদ্ভুত সব জন্তু এবং শিকারের দৃশ্য বর্ণিত হলেও প্রধান ছবিতে দেখা যায় কুঠার হাতে যোদ্ধাগণ, ঢাল-তলোয়ার-তির-ধনুকের লড়াই।
এই দুই মহারথি এবং হেস্টিঙ্গসের যুদ্ধ (Battle of Hastings) নিয়েই নতুন সিরিজ শুরু হল, নাম রাখলাম ১০৬৬ এডি। এটি ঠিক ফানিপানি নয়, কিন্তু মাঝেমধ্যে একটু হাস্যরস অামদানি করার চেষ্টা হবে বৈকি। এই সিরিজ লেখার ইচ্ছে জেগেছে কিছুদিন অাগে একটা দারুণ বই হাতে পেয়ে। ইচ্ছে ছিল বইটি সোজাসুজি অনুবাদ করব, কিন্তু সে ক্ষমতা নেই দেখে বই অনুসরণ করেই লিখে যাব। কিছু কিছু কথা বই থেকে সরাসরি অনুবাদ করা থাকবে, কিন্তু বেশিটাই নিজের ভাষায়–ইন ইয়োর ওন ওয়ার্ডস–লেখার চেষ্টা করব। বইটির নাম The Battle of Hastings, লেখক Chris Priestley। বাচ্ছাদের জন্য লেখা বই, ওয়েবসাইট বলছে ৯-১৪ বছরের জন্য। তবে বইটি এই বুড়ো বয়সেও বেশ লাগছে। দাম বলে কিনা প্রায় অাঠাশ পাউন্ড, অামি তো বাপু সেকেন্ড হ্যান্ড বইয়ের দোকান থেকে কুড়ি টাকায় পেলুম। মহাপ্রভু চেতন ভগত বাবাজি পদার্পণ করার পর ইতিহাসকে লোকে তেমন পাত্তা দিচ্ছে না দেখছি।
— —
সোমদেব ঘোষ, ২০১৫-১১-১৩, কলিকাতা শহর।
অনেক দিন পর একটা ব্লগ পোস্ট পড়ে শুধু ভালো লাগল না, পড়তে পড়তে হাসিও পেলো।
LikeLiked by 1 person
হে হে থ্যাঙ্কু। হাগানে নো রেনকিনঝুতশুসি রিভিউ করার মাঝে মাঝে একটু ঘটিবাটি পড়ে চাঙ্গা হয়ে নিও। এই ঐতিহাসিক সিরিজও চলবে, চোখ রেখো। 🙂
LikeLiked by 2 people