হলুদ দুই : নো রিফিউসাল

“ট্যাক্সি!”

হলুদ ট্যাক্সিটা ঘ্যাঁচ করে সামনে এসে ব্রেক কষল। শুনে বুঝলুম, ঠিক ঘ্যাঁচ করে নয়, একটু যেন ঘ্যাঁসস মিশে অাছে। স্লিপ করছে ব্রেকটা। মেকানিককে দেখানো উচিত। ঠিক করলাম যদি যায় ড্রাইভারকে বলব।

“কোথায় যাবেন?”

অামি গন্তব্য বললাম।

“উঠে পড়ুন,” বলে সে মিটার চালিয়ে দিলো।

হাতে স্বর্গ পেলাম। এত রাতে রাজি? তাও একই ভাড়া ডাবল না। অাবার এ তো নো রিফিউজাল ট্যাক্সিও নয়।

শুধোলাম ড্রাইভারসায়েবকে। এই অন্ধকারে ভদ্রলোকের মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু মাথা প্রায় ট্যাক্সির ছাতে ঠেকেছে। কথা শুনে তো বাঙালিই মনে হল। বেশ চেহারা তো।

“রিফিউজ তো করতেই পারি দাদা, কিন্তু তাতে অামরাই তো মার খাবো। ওই নীল-সাদা নো রিফিউজাল তো ভাতে মারছে। অামরাও যদি না নি প্যাসেঞ্জারকে, তাহলে তো ধুঁকে-ধুঁকে মরবো দাদা। স্লো ডেথে অামার ভীষণ ভয় দাদা। জিও খুলকে, মরো তো এক নিমেষে সব শেষ।”

“হে হে ঠিকই বলেছেন” বলতে বলতে অামি কাঁধের ব্যাগটা পাশে সীটে রাখলুম। গাড়ি ছুটে চললো ডায়মন্ড হারবার রোড ধরে। খানিকক্ষণ চোখ বুজে গতকালে কাজটাকে মনে মনে রিভিউ করলাম। নিজেই নিজের তারিফ না করে পারলাম না। গুড ওয়ার্ক। চোখ খুলে সামনে তাকিয়ে দেখলুম, রিয়ারভিউ মিরারে ঝুলছে একটি সবুজ সিমলে লঙ্কা। অাশ্চর্য ব্যাপার। এমনিতে তো লোকে লেবু-লঙ্কা ঝোলায়। জিজ্ঞেস করলুম।

“যারা কুসংস্কারে ভোগে তারা ঝোলায়। অামায় দেখে মনে হয় অামার ওসব বিশ্বাস অাছে?”

“কী করে বলব বলুন, ওঠার পর থেকে অাপনার মুখটাই তো ঠিকমতো দেখতে পেলুম না।”

“মুখ দেখে অার কী করবেন দাদা? ট্যাক্সি ড্রাইভারদের অাবার দেখতে অাবার কীরকম হবে?”

“তাহলে কী করে বুঝবো বলুন, অাপনি অন্যদের চেয়ে অালাদা?”

“অামি এম-এ ডিগ্রী হোল্ডার, জানেন?”

“কীসে?”

“সাইকোলজি।”

“মনস্তত্ব ছেড়ে ট্যাক্সি?”

“পেট তো চালাতে হবে দাদা। বাবার ডেথ হয়ে গেল, দাদা রেলে কাজ করতো, একদিন লাইন ইন্সপেকশনে কী ভেবে গিয়েছিলো একা, লাইনে পা অাটকে অাছড়ে পড়ে সেন্সলেস হয়ে গেল, অার তখনই একটা ট্রেন…”

“দেখতে পায়নি কেউ?”

“লাইনটা ওখানে বাঁক খায়। সুপারফাস্ট এক্সপ্রেস ছিল। পাইলট সময় পায়নি।”

“ও হো। খুবই দুঃখের কথা।”

“সে অনেকদিন হয়ে গেল। অামার তখন এম-এ পরীক্ষা জাস্ট শেষ হয়েছে। বৌদি-ভাইপো-ভাইঝি-মা-বোন সকলে অামার ঘাড়ে পড়ল। চাকরি খোঁজার অার চান্সই পেলুম না।”

“তাই ট্যাক্সি?”

“প্রথমে অটো ধরলাম। পাড়ার বঙ্কাদার পায়ে পড়লুম, একটা হিল্লে যদি করে দাও। বঙ্কাদা অটো ইউনিয়নের লোক, অামাকে একটা অটো ধরিয়ে দিল। চালালুম বছর তিনেক। তারপর এই ট্যাক্সি ধরেছি।”

“ট্যাক্সিটা অাপনারই?”

“মাথা খারাপ? নুন অানতে পান্তা ফুরোয়, ট্যাক্সি কেনার সামর্থ্য অামার কোনদিনও হবে কিনা সন্দেহ। এটার মালিক অাছে, অবাঙালি। ওই বঙ্কাদার রেফারেন্সেই…”

“ইনি তো বেশ ইয়ে লোক মনে হচ্ছে।”

“বঙ্কাদা তো? ও বাবা, পার্টি করে। রাইজিং স্টার।”

“অাপনি যে এরকম অচেনা লোকের সঙ্গে এসব কথা বলছেন, সংকোচ হচ্ছে না?”

“দাদা, লাক ব্যাপারটা অামি মানি।”

“তাই নাকি? সাইকোলজির ছাত্র লাক মানে? এ যে উল্টো সুর।”

“এসব লাইনে ভাগ্যের ব্যাপার দাদা। কোনওদিন ভাল প্যাসেঞ্জার পেলাম, কোনওদিন পেলাম না। কোনওদিন গাড়ি বিগড়ে গেল, কোনওদিন ট্র্যাফিক চালান ধরিয়ে দিল–কিস্যু করিনি, বলল রেড লাইট পেরিয়েছিস, হাজার দে। প্রথম-প্রথম অামিও এসব লঙ্কালেবু এড়িয়ে চলতাম, কিন্তু মালিক অাবার ভীষণ এসব বিশ্বাস করে, বলল রাখতেই হবে গাড়িতে। গাড়ি ওনার, তাই ওনারই চলে।”

“কিন্তু সিমলে লঙ্কা?”

“কী হয়েছে, অামি ওই প্রথমদিকে ওনাকে শান্ত করার জন্য হুঁহুঁ করে মাথা নেড়ে সকালে গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে ওনাকে দেখিয়ে দিতাম লাগানো অাছে।”

“তারপর বেরিয়ে গিয়ে খুলে রাখতেন?”

“অ্যাই অ্যাকদম ধরেছেন। খুলে ওই ড্যাশবাক্সে রেখে দিতাম।”

“কীসে রেখে দিতেন?”

“ড্যাশবাক্সে। এই যে, সামনে যে দুটো জায়গা থাকে।”

“ও, গ্লাভ কম্পার্টমেন্ট? ভাল নাম দিয়েছেন তো। বেশ একটা ক্যাশবাক্স টাইপের গন্ধ অাসছে।”

“হে হে যা বলেছেন। অাপনাকে দেখে ভালো লোক বলেই মনে হয়, অার অামার সবুজ ক্যাপসিকাম অাছে, কোন অনিষ্ট হবে না। ক্যাশবাক্স কথাটা নিতান্ত ভুল বলেননি।”

“ও, ওখানেই সব ভাড়া…?”

“ওখানেই।”

“ধরুন, সিগন্যালে দাঁড়ালেন, কেউ যদি হাত বাড়িয়ে খুলে নিয়ে নেয়?”

“কে অার জানবে বলুন?”

“এই যে অামি জানলুম।”

“অাপনাকে যদি অামি এই ট্যাক্সিতেই খুন করে লাশ রাস্তার পাশের ঝোপে ফেলে দিই, কে জানবে? হাইওয়ে দিয়ে চলছি, এত রাতে জনমানব নেই, কেউ জানতেও পারবে না। ইদানিং ট্যাক্সিতে অনেক খুন হচ্ছে, কাগজে পড়েননি? ধরুন অামি যদি সেই লোক হই?”

বুকের ভিতরটা একটু কেঁপে উঠল কী? শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত? কপালে বিন্দু দুয়েক ঘাম, এই ডিসেম্বরের রাতে?

গলাটাকে এক অক্টেভ নামিয়ে বললুম, “মস্করা হচ্ছে এই রাতবিরেতে? কথা বলছি বলে যা ইচ্ছে তাই বলবেন? এটা ইয়ার্কির ব্যাপার?”

ড্রাইভারসায়েব হোহো করে হেসে উঠল।  “সেকী দাদা, এটুকুতে ভয় খেয়ে গেলেন? অাপনি পুরুষমানুষ, অত সহজে ভয় পেলে চলে? ভয় পাবে মেয়েমানুষ।”

“ভয় পাবে মেয়েমানুষ?” অামার চোখ কপালে।

“তা নয় তো কী? দাদা মারা যাওয়ার পর সামলালুম তো অামিই। বৌদি কুটোটি নেড়েছে? একটা কিছু কাজ-টাজ তো জোগাড় করতে পারতো না কী? তা না, অামার ঘাড়ে চেপেই…”

“ছেলে-মেয়েকে তো মানুষ করতে হবে। দাদা মারা যাওয়ার সময় নিশ্চই ওরা খুব ছোট ছিল। অার স্বামী মারা গেলে লোকে তো একটু…”

“অারে সে তো বহুকাল হয়ে গেল, সাত বছর প্রায়। এদ্দিনে সে কিছু জোগাড় করতে পারল না? ছেলে-মেয়ে তো ইস্কুলে যায়, তাদের কি অার সারাদিন বসে-বসে মুনতে হয়? না হোক কোন বাড়িতে নাহয় রান্নার কাজ…”

“অাপনার ইঙ্কামে বাড়ি চলে না?”

“চলে, তাও লোকের তো একটু স্বচ্ছল হতে ইচ্ছে করে, বলুন? তার বয়স অাছে, সে জোয়ান অাছে, গায়ে-গতরে খাটার তার এখনও এনার্জী অাছে…”

“অার অাপনার সবুজ ক্যাপসিকাম অাছে।”

ড্রাইভারসায়েব অারেকবার সেই প্রাণখোলা হাসিটা হাসলো। গাড়ির শব্দ ছাড়িয়ে সে হাসি যেন রাস্তা পেরিয়ে অন্ধকার ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ল। কেন জানি মনে হতে লাগলো শব্দটা অামাকেই ফলো করছে। কপালে ঘামটা বেশ জমেছে মনে হল।

“অাপনি প্রথম প্যাসেঞ্জার যিনি এতটা ইন্টারেস্ট নিয়ে ক্যাপসিকাম নিয়ে জিজ্ঞেস করছেন। শুনুন তাহলে। একদিন গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে লেবুলঙ্কা রেখেছি ড্যাশবাক্সে। তেল ভরার ছিলো, পাম্পে গিয়ে ভরবো, বিশু–সে অন্য একটা ট্যাক্সি চালাতো–বলে একটা বিড়ি দে। বললাম, নিয়ে নে, ড্যাশবাক্সে অাছে।”

“সে কী, ওখানে টাকা ছিল না?”

“টাকা থাকতো অন্যটাতে। অার দিনের শুরু তো, টাকা তো জমে নি।”

“এখন অাপনার ওই ড্যাশবাক্স ভরতি নিশ্চই।”

“ফুললি। লোডেড।”

“অাপনার সাহস অাছে, অামাকে সব বলছেন। এটাও কি ওই সিমলে লঙ্কারই গুণ?”

থার্ড টাইম লোকটা অট্টহাসি করলো। থার্ড টাইম। ফলো করছে অাওয়াজটা। ভয়টা…

“তাহলে বলি শুনুন। অাপনার যা প্যাংলা চেহারা…অামি কলেজে ওয়েটস্ তুলতাম। মুখ দেখতে নাই পান, চেহারা দেখছেন তো? ছয় চার অামি, চওড়াতেও ওরমই। অটো স্ট্যান্ডে ঝামেলা রেগুলার লাগতো। অাপনার মতো তিনটেকে অামি তুলে ফেলে দিতে পারি, বুঝলেন?”

“অামার কাছে যদি বন্দুক থাকে?”

“অাপনাকে যে এতগুলো কথা বলেছি, এমনি এমনি নাকি? ড্যাশবোর্ডে অত টাকা কেউ না সিকিওরিটি নিয়ে রাখে? বাঁদিকেরটা দেখছেন, ওতে একটা ওয়ান শটার অাছে। নিশানা করার ফান্ডা নেই, তাক করে কাছ থেকে চালালে থোঁতামুখ ভোঁতা হয়ে যাবে, বুঝলেন?”

“ও, তাহলে ওই সবুজ ক্যাপসিকাম নিতান্তই ফর শো? মস্করা করছিলেন?”

“তা নয় তো কী? ওসব দিয়ে অাজকাল চলে নাকি, লাক-ফাক? যারা ওই ভেবে চলে তারা মুখ্যু। অামার সিক্রেট ওয়েপন…”

“ওয়ান শটার?”

“বঙ্কাদা ছাড়া কেউ জানে না, বুঝলেন? ওই তো অামাকে এনে দিয়েছে। শুনুন, সাইকোলজি এম-এ ডিগ্রী নিয়ে অাজকাল কিছু হয় না, বুঝলেন? এই যে চেহারা দেখছেন, একবার ভয় দেখালে বাছাধনেরা সুরসুর করে চাঁদা বের করে দেয়।”

“অাপনি ভয় দেখান বুঝি?”

“অামাকে দেখে লোক অটোম্যাটিকালি ভয় খায়। অাপনি তো অামায় বসেই দেখছেন, দাঁড়ালে বুঝতেন, ভয় পাওয়া কাকে বলে।”

অামি ব্যাগ থেকে প্লাস্টিকের প্যাকেটটা বের করে অানলাম।

“শুনুন। অাপনাকে দেখে লোক ভয় পেতে পারে, কিন্তু তারা অাদপেই ভিতু লোক, বুঝলেন? ভয়-ভয়েই মরে অাছে জন্ম থেকে মৃত্যু। ওদেরকে ভয় দেখানোতে কোন বাহাদুরি নেই। কিন্তু অাপনার মতো এরকম একজন পুরুষসিংহ লোক…বলতে মনে পড়ল, অাপনি বিয়ে করেননি কেন? তিরিশ বছর বয়স হতে চলল…বৌদিকেই তো…?”

“মেয়েমানুষকে পাতের খাবার গায়ের কাপড় দিচ্ছি, একটু রিটার্ন পাবো না?”

“ঠিকই ধরেছি। তো অাপনার মতো পুরুষসিংহ লোক অামার মতো..কী যেন কথাটা বললেন, প্যাংলা? অামার মতো প্যাংলাকে ভয় কেন পেতে যাবেন? কিন্তু ধরুন সত্যিই যদি অামাকে ভয় পান অাপনি? বেশ একটা ম্যাজিক হবে, তাই না?”

“অামি অাপনাকে ভয় খেতে যাবো কেন? কখনই নয়।”

“বেট ধরবেন? জুয়া খেলেন নিশ্চই। তিনপাত্তি, তাই তো?”

“হ্যাঁ, কিন্তু অাপনি কী করে…?”

“বাজি। রাজি?”

“কী বাজি ধরবেন?”

“অামি হারলে অাপনাকে ডবল ফেয়ার দেব, অার অামি জিতলে অাপনি হাফ নেবেন। সোজা হিসেব। অনেস্টলি বলতে হবে কিন্তু ভয় পেলে।”

“কী করতে হবে?”

“বিশেষ কিছুই নয়। অাপনাকে জাস্ট একটু…একটু পাশ করে গাড়িটা দাঁড় করান…ওই সবুজ ক্যাপ্সিকামটা খুলে এই বেল পেপারটা লাগাতে হবে।”

“ব্যস? অার তাতেই অামি ভয় খাবো? ডবল ভাড়া বের করুন।”

“ম্যাজিকটা শেষ হয় নি। অাগে লাগান তো।”

ড্রাইভারসায়েব চুপচাপ সবুজ ক্যাপ্সিকামটা খুলে প্যাকেট থেকে বের করা হলুদ বেল পেপারটা লাগালেন। খুশি হয়ে দেখলাম একদম দুলছে না। গুড। অট্টহাসিটাও পাওয়া যাচ্ছে না, হঠাৎ যেন কাট-অফ হযে গেছে। ভেরি গুড।

“হ্যাঁ এবার গাড়ি স্টার্ট করুন। চলতে থাকুন, গ্যারান্টি দিচ্ছি ভয় পাবেন। সামনেই পাবেন একটি অানম্যান্ড লেভেল ক্রসিং। ডায়মন্ড হারবার রোডে অানম্যান্ড লেভেল ক্রসিং নেই বলছেন…? লেভেল ক্রসিংই নেই বলছেন? ঠিক কথা। কিন্তু অাপনি যে খানিকক্ষণ অাগে রাস্তা পালটেছেন খেয়াল করেননি? ও হো, খেয়াল করার তো কথাও নয়। অাপনি অামায় যে এতগুলো কথা বললেন, বলেছেন অার কাউকে কখনও? ড্যাশবাক্সে টাকা নিয়ে, ওয়ান শটার নিয়ে…অাপনার বৌদিকে অাপনি রোজ রাতে…বলেন নি তো? ভয় একটু করছে তো? করাটাই স্বাভাবিক। বুকের ভিতরটা একটু কেঁপে উঠল কী? শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত? কপালে বিন্দু দুয়েক ঘাম, এই ডিসেম্বরের রাতে? সিম্পটম, বুঝলেন, সিম্পটম। ভয়ের। সামনেই লেভেল ক্রসিং দেখছেন তো? গুড। টাইম ক’টা দেখি? এগারোটা পঁচিশ। বেশ। গাড়িটা থামান।”

ঘ্যাসস করে ব্রেক লাগলো। স্লিপ অাছে, নির্ঘাত। নামতে নামতে বললুম ওনাকে, মেকানিক দেখাতে। নেমে টেমে ব্যাগটা কাঁধে অ্যাডজাস্ট করে চেন খুলে সবুজ ক্যাপসিকামটা ভিতরে রাখলাম। স্যুভেনীর। সামনের ড্রাইভারের সাইডের জানালায় গিয়ে দাঁড়িয়ে হেডলাইটটা অার পার্কিং লাইটটা অফ করতে বললুম। পুরো জায়গাটা অন্ধকারে ডুবে গেল। মন দিয়ে শুনলাম, ঝিঁঝিঁ পোকাও ডাকছে না। চারিদিক নিস্তব্ধ। গুড। ভয় পেয়েছে রাত্রি।

“বুঝলেন তো, অাপনার রিফিউজ করা উচিত ছিল। রাতবিরেতে অচেনা লোকেদের সঙ্গে কথা বলতে নেই, অাপনার মা শেখাননি? নো রিফিউসাল ট্যাক্সিও নয় অাপনার, হলুদ ট্যাক্সি। হলুদের কি ভয় পেলে চলে, হলুদ তো নিজেই ভয়। দ্য ওনলি থিং টু ফিয়ার ইজ ফিয়ার ইটসেল্ফ। না না, চোখ সামনে, সোজা রাখুন, নড়াবেন না। হাত স্টিয়ারিঙেই রাখুন। গাড়ি নিউট্রালে অাছে তো, গুড। পা-টা অালতো চাপ দিন অ্যাক্সেলেটরে…উঁহু, উঁহু, হলুদ বেল পেপারটা দেখুন, অাপনার সামনেই ঝুলছে…হ্যাঁয়য়…অালতো চাপ দিন…এবার অারেকটু জোরে…অাঃ, রাইট অন টাইম, এগারোটা পঞ্চাশের লোকালটা অলওয়েজ পাঙ্কচুয়াল। ভয় পাবেন না, হলুদ ট্যাক্সিতে অাছেন, সামনেই হলুদ ক্যাপসিকাম…অাপনি তো ভয়ের ভিতরে অাছেন, ভয় অাপনাকে গ্রাস করে নিয়েছে। এবার অাপনি ফ্রী। এসব কেন করছি? টাকার জন্য? টাকা দিয়ে কী হবে? করছি কেননা করতে পারি, বুঝলেন? বিকজ অাই ক্যান। নিন, নিন, লেট হয়ে যাচ্ছে, ট্রেনটা মিস হলে অাবার ঝক্কি। অ্যাক্সেলেটরে জোরে পা রাখুন, হেডলাইট-পার্কিং লাইট অফ তো? গুড। রেস দিন জোরে, ট্রেনের যা অাওয়াজ, শুনতে পাবে না। ক্লাচে পা দিন। অামি পিছু হটছি, ‘গো’ বললেই গিয়ার দেবেন, ওক্কে?”

ট্রেনের অাওয়াজ শুনতে অামার চিরকাল ভাল লাগে। অালোটা হুইসলটা লাইনের ঘটাং ঘটাংটা। কেমন একটা রূপকথার দৈত্য যেন। বড় হয়ে বুঝলাম, ট্রেন অারেকটি কাজে ভীষণ লাগে। মোমেন্টাম বলে একটা জিনিস অাছে, স্কুললাইফে ফিজিক্সে ছিল। একটি অতি বিশাল ভরের বস্তুকে যদি মোটামুটি গতিতেও চালনা করা যায়, এবং তারপর খুব কম সময়ের মধ্যে যদি সেই গতিতে প্রচন্ড হেরফের ঘটানো যায়–যেমন ব্রেক কষা বা কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খাওয়া–তাহলে এই মোমেন্টাম খুব তাড়াতাড়ি পাল্টাবে। যত তাড়াতাড়ি পাল্টাবে, মানে রেট অফ চেঞ্জ যত বেশি, তত বেশি বল প্রয়োগ হবে। ফোর্স তত বেশি হবে। বেশি জোরে ধাক্কা খাবে। এটা নিউটনের দ্বিতীয় ল অফ মোশান। ট্রেনের সুবিধা হল, ভর বেশি, গতিও রাতের বেলা মোটামুটি ভালই থাকে। গাড়ি টাইপের কিছু জিনিসের সঙ্গে ধাক্কা খেলে ট্রেনবাবাজির কিছুই হবে না, কিন্তু গাড়িটা–এবং তাতে যদি কোন অারোহী থাকে দুর্ভাগ্যক্রমে–দুমড়ে-মুচড়ে পাঁপড়ভাজা হবে। খুব সুবিধে। অ্যাক্সিডেন্ট বলে কথা? অানম্যান্ড লেভেল ক্রসিং এইজন্যই ভালো। হুম, রাস্তার ধারে এসে গেছি মনে হচ্ছে, ট্রেনটাও…

“গো!”

সোমদেব ঘোষ, ২০১৫-১২-১১, রাত এগারোটা পঞ্চাশ, কলিকাতা শহর।

17 thoughts on “হলুদ দুই : নো রিফিউসাল

    1. থ্যাঙ্কু। পাঠকের ভাল লাগলে, এবং সেটা বললে, খুব ভাল লাগে।

      এটা হলুদ সিরিজের দ্বিতীয় কিস্তি, প্রথমটি এখানে : https://ghotibaatea.wordpress.com/2015/11/28/%e0%a6%b9%e0%a6%b2%e0%a7%81%e0%a6%a6-%e0%a6%8f%e0%a6%95/।

      🙂

      Like

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান