গিভ মী সাম সানশাইন

— লাইফ ইমিটেটস অার্ট, না অার্ট ইমিটেটস লাইফ?
— হ্যালো, কে বলছেন?
— শ্রীঘোষের সঙ্গে কথা বলছি কী? অাপনি কি ঘটিবাটীতে লেখেন?
— কারেক্ট, ঠিক লোককেই ধরেছেন বটে। অাপনার পরিচয়টা যদি দেন, প্লেয়িং ফীল্ডটা লেভেল হয়ে যায়।
— অামি বিপ্র।
— বিপ্র? বিপ্রজিত দত্ত? যদুবংশীয়?
— অাজ্ঞে না। অামি উনি নন।
— অাচ্ছা? অামার নম্বর পেলেন কী করে?
— অাপনিই দিয়েছিলেন শ্রীঘোষ।
— অামি? অাপনার সঙ্গে দেখা হয়েছে কোথাও?
— হয়েছে বৈকি। ঘটিবাটীতেই দেখা হয়েছে।
— ঘটিবাটীতে দেখা হয়েছে? মানে?
— মানে মনে করে দেখুন, মাসদুয়েকের বেশি হয়ে গেল, অাপনার তখন ব্রজবুলি ফেজ চলছে। শিঙাড়াবাবাজী অার নিতাইকে নিয়ে লিখছেন।
— দেখুন মশাই, অাপনাকে অামি একেবারেই চিনতে পারছি না। বিপ্র বলে অামি অার কাউকে সত্যিই চিনি না…দাঁড়ান দাঁড়ান, কী নাম বললেন? বিপ্র? অাপনি বিপ্র?
— বিপ্রই বটে।
— কিন্তু এটা অাপনার নাম ঠিক না, তাই তো? ইনিশিয়াল্স।
— অাজ্ঞে ঠিকই ধরেছেন। অামার পুরো নাম বিপ্লবী প্রশ্ন।
— ইয়েস ইয়েস, মনে পড়েছে। অারে অাপনি তো বিখ্যাত ব্যক্তি।
— বিখ্যাত?
— অালবাত।
— তাই বুঝি? অার কে কে জানে অামার নাম?
— এই তো, প্রচেত লাহা জানে, প্রাণকেষ্ট পুরকায়স্থ জানেন, অার…অার…
— অার অাপনি জানেন, তাই তো?
— (লাফিয়ে উঠে) অার ব্রজদা জানেন।
— অাজ্ঞে তা ঠিক, উনিও জানেন বৈকি। বিখ্যাতই বটে।
— কেমন একটা সার্কাজমের গন্ধ পাচ্ছি।
— পাচ্ছেন বুঝি? অাপনার নাক তো খুব শক্তিশালী।
— বিপ্রবাবু, ফোনটা অাপনিই করেছেন, ব্যালেন্স অাপনারই যাচ্ছে। অস্কার ওয়াইল্ডের উক্তি দিয়ে কখনও কাউকে ফোন কথোপকথন শুরু করতে শুনিনি। অামি কিউরিয়াস।
— অস্কার ওয়াইল্ড ধরতে পেরেছেন শুনে খুব ভাল লাগছে। ঘোসবাবু হলে পারতেন না বোধহয়।
— না, উনি পারতেন না বটে।
— অাজ্ঞে হ্যাঁ। অাপনাদের অনেক দিন ধরেই স্টাডি করছি তো।
— বেশ। খুব ভাল কাজ করেছেন। এবারে বলুন, লাইফ ইমিটেটস অার্ট…
— থ্রী ইডিয়টস দেখেছেন?
— সিনেমাটা? নিশ্চই। ভীষণ ভাল লাগে।
— গানটা মনে অাছে?
— গানটা…কোন গানটা বলুন তো, বহতি হভা সা থা তুউউ?
— অাজ্ঞে না। ওটাও ভাল গান, নিঃসন্দেহে। তবে অামি বলছি “গিভ মী সাম সানশাইন” গানটার কথা।
— ওঃ। হ্যাঁ, গানটা শুনলে মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়।
— কাগজ পড়েন?
— কাগজ? খুব একটা হয়ে ওঠে না।
— পড়েও কতটা লাভ অাছে জানি না। অাপনাদের তো অানন্দবাজার অাসে বাড়িতে, তাই না?
— তা অাসে।
— ফেসবুকে…মানে অাপনি মুখবই বলেন, সেখানে দেখেছেন নিশ্চই।
— কী দেখেছি বলুন তো। অনেক কিছুই তো দেখে থাকি মুখবইতে। জায়গাটা দার্শনিক চিড়িয়াখানা একটা।
— দার্শনিক চিড়িয়াখানা? ভাল বললেন তো।
— থ্যাঙ্ক্যু। অারেকটা কথা বলি?
— বলুন।
— অাপনি কেন ফোন করেছেন অামি জানি। কেন অস্কার ওয়াইল্ড দিয়ে শুরু করেছেন অামি জানি। কেন “গিভ মী সাম সানশাইন” অার “লাইফ ইমিটেট্স অার্ট” বলার চেষ্টা করছেন তাও বুঝে গেছি।
— তাহলে তো কথাই নেই।
— শুনুন বিপ্রবাবু, রোহিত ভেমুলার মৃত্যুখবর…
— অাত্মহত্যার খবর।
— …অাত্মহত্যার খবর অামি মুখবইতেই পাই। কাল থেকে ওর লেখা চিঠিটা মন বারে বারে মনে ধাক্কা দিচ্ছে। বন্ধুদের এ নিয়ে লেখা পড়ছি। মনটা অারও খারাপ হচ্ছে, কিন্তু ভালও লাগছে, ছেলেটার মৃত্যুতে অন্তত মানুষ জেগে তো উঠেছে। এই তো, অামার এক বন্ধু, বাঙালী কলমধারী, পেশায় তৈলকর্মচারী, একটি অত্যন্ত সুন্দর লেখা লিখেছেন এটা নিয়ে।
— ওনার লেখাটা পড়লাম। ভাল লেখেন তো ভদ্রলোক, তাও লোকে শুনেছি ওনার পরিচয় দেন “মটোনবিরিয়ানীবিশারদ” বলে।
— সেটাই দুঃখের ব্যাপার।
— কিন্তু রোহিতকে মরতে কেন হল শ্রীঘোষ?
— এটাই কি অাপনার বিপ্লবী প্রশ্ন বিপ্রবাবু?
— এটা প্রশ্ন শ্রীঘোষ। প্রশ্নের কি অার শ্রেণীবিভাগ থাকে?
— অাপনি তো নিজেই নিজের অস্তিত্বকে কনট্রাডিক্ট করছেন।
— অাজ্ঞে কনট্রাডিক্ট করছি না, এনহান্স করছি।
— তাহলে অাপনি জানতে চাইছেন রোহিত ভেমুলা কেন মরলো?
— কেন তাকে মরতে হল। এর কারণ কী? ছাত্ররাজনীতি? জাতপাতের রাজনীতি? ইয়াকুব মেমনের ফাঁসি নিয়ে ওদের প্রতিবাদ করা এবং তার পরে একটি ছাত্ররাজনৈতিক লীডারের সঙ্গে ধ্বস্তাধ্বস্তি হওয়া? হোস্টেল থেকে বিতাড়িত হওয়া? চূড়ান্ত ক্ষোভ, হতাশা, অপমান?
— বিপ্রবাবু, এসব প্রশ্ন করে এখন অার কী হবে? যখন অত মাস তাঁবু খাটিয়ে সে এবং তার চার বন্ধু থাকতো, কেউ এসে ডেকে জিজ্ঞেস করেছে তাদের, কেমন অাছিস? হয়তো তাদের বন্ধুরা করেছে, অার কেউ করেছে? এই যে যারা অাজ সোশ্যাল মিডিয়া ছারখার করে দিচ্ছে হ্যাশট্যাগ রোহিতভেমুলা দিয়ে, তারাও তো করেনি, তাই না? অাবার ওর বডি নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে, কেউ কেউ শুনছি ‘৯২ সালের চুনী কোটালের কেস টেনে অানছেন। তাদের প্রশ্ন, যারে রোহিত ভেমুলাকে নিয়ে শোরগোল করছে, চব্বিশ বছর অাগে তারা কোথায় ছিলো?
— এসব প্রশ্নের জবাব অাছে অাপনার কাছে শ্রীঘোষ?
— না বিপ্রবাবু, নেই। সত্যিই নেই। থাকলেও কোন লাভ হতো না। রোহিতের বাবা-মা তো অার ছেলেকে অার ফিরে পাবেন না, বা অভিমন্যু গৌড়ের বাবা-মাও তার ছেলের গলা অার কখনও শুনতে পাবেন না। লোকে মারা যায় বিপ্রবাবু। মৃত্যতে কোন পুণ্য নেই, কোনও পাপ নেই। নেই কোনও রোম্যান্টিসিজম, নেই কোনও কাব্য। মৃত্যু অ্যাবসোলিউট। ফাইনাল। নিহিল অাল্টরা। ওর পরে অার কিছু নেই। নাথিং বিয়ন্ড। রোহিতকে মরতে হয়েছে কেননা রঙবাজি করাটা মানুষের ডি-এন-এর মধ্যে গেঁথে অাছে। গৌড়কে মরতে হয়েছে কেননা অন্য ধরনের রঙবাজি করাটাও মানুষের রক্তে মিশে অাছে। মানুষ মাত্রেই খুব অদ্ভুত একটি জীব বিপ্রবাবু। হলোকস্ট-হিরোশিমাও যেমন করতে সে সিদ্ধহস্ত, সনেট-সিম্ফনী তৈরিতেও সে সমান পটু। মানুষ নিজেই একটা কন্ট্রাডিকশন, নিজেই নিজের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত, কনফ্লিক্ট তার ব্রেকফাস্ট-লাঞ্চ-ডিনার। কনফ্লিক্ট না থাকলে মানুষ কি এতদূর অাসতে পারতো? রকেট ছুঁড়তে পারতো চাঁদ-মঙ্গল-ঊর্টমেঘপুঞ্জের দিকে? পারতো দুঘন্টায় অশীতিপর ব্যক্তির চোখের ছানি পাল্টে নতুন চোখ দিতে? পারতো ল্যাপটপের চাবি টিপে বিশ্বজয় করতে? দ্বন্দ্বের অন্য দিকও অাছে। দ্বন্দ্বের জেরেই তো মালালা প্রায়, ইরম শর্মিলা প্রায়, অার নির্ভয়া সম্পূর্ণ।
— শ্রীঘোষ, অামার চলে যাওয়ার সময় এসেছে, একটা শেষ প্রশ্ন করবো।
— শুনি।
— মানুষ দ্বন্দ্ব ছাড়া বাঁচে না জানি। কনফ্লিক্ট বিগেট্স ক্রাইসিস, ক্রাইসিস ডিম্যান্ডস চেঞ্জ, চেঞ্জ প্রোপেলস সিভিলাইজেশন। Conflict begets Crisis, Crisis demands Change, Change propels Civilisation। কিন্তু শ্রীঘোষ, এই যে অাপনি এতকিছু বললেন, এতগুলো নাম বললেন, এতগুলো ঘটনা বললেন…অাপনি এ নিয়ে কী করেছেন? হয়তো বন্ধুদের সঙ্গে চায়ের কাপে তুফান তুলেছেন, হয়তো সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট লাইক করেছেন, শেয়ার করেছেন। হয়তো দু-চার লাইন লিখেওছেন কখনও কখনও। কিন্তু এছাড়া অাপনি কি নিস্পৃহ নন? অাপনি কি নিউট্রাল নন? খোলসে ঢুকে বসে নেই অাপনি, নিজের চারধারে বর্ম পরে? সাইমন গার্ফাঙ্কেল শুনে অাপনি এতটাই মুগ্ধ যে অাপনি দ্বীপের পাথর হয়ে বসে অাছেন? You are an island? You are a rock?
— কেন জানেন বিপ্রবাবু? পরের লাইনটা শুনুন। A rock feels no pain. And an island never cries। পাথর কি কখনও ব্যাথা পায়, দ্বীপ কি কখনও চোখের জল ফেলে?
— শ্রীঘোষ, অাপনি হিপোক্রিসি নিয়ে খুব লেখেন, তাই না?
— লিখছি বৈকি। কেন?
— কেননা, অাপনার ম্যাগি লেখাটার মতোই বলছি…দিস। ইজ। হিপোক্রিসি। চলি।
— ভুল করছেন বিপ্রবাবু। অাপনার কাজ প্রশ্ন নিয়ে, উত্তর নিয়ে কারবার অাপনার নয়, তাই অাপনি বুঝবেন না। এটা হিপোক্রিসি নয়। এটা জীবন। লাইফ ইজ অা সাম টোটাল অফ চয়েসেস মেড অ্যান্ড অানমেড। Life is a sum total of choices made and unmade. And it is always a zero-sum game। এলাম খালি হাতে, যাবোও খালি হাতে। এক বাঁও মেলে না, দো বাঁও মেলে নাঅাঅাঅা…তলটা যেদিন খুঁজে পাবো বিপ্রবাবু, অঙ্কটা যেদিন মেলাতে পারবো, ফোন করবেন, অারেকপ্রস্থ কথাবার্তা হবে। ভাল মকাইবাড়ির চা অাছে, একটু তুফান তোলা যাবে না হয়। কী বলেন? বিপ্রবাবু? শুনছেন? বিপ্রবাবু। বিপ্রবাবু!!!

ফোনটা ততক্ষনে কেটে গেছে। রিংটোনটা হাওয়া ভাসতে ভাসতে ঈথারে অাশ্রয় নিয়েছে। শোনা যাচ্ছে এক পাহাড়ি ছেলের কন্ঠ, হাতে চকোলেট, মুখে হাসি। লেপচা ভাষায় কী গাইছে জানি না, জানার প্রয়োজনও নেই।


 

সোমদেব ঘোষ, দুপুর সোয়া একটা, উনিশে জানুয়ারী, ২০১৬ সাল, কলিকাতা শহর।

3 thoughts on “গিভ মী সাম সানশাইন

  1. ভাল লাগল বললে কম বলা হবে… 🙂

    আরো একটা কথা, আপনি বাংলায় ব্লগান দেখে খুব ভাল লাগল, বাংলা ব্লগ সত্যি কম এবং যে-কটি বা আছে, তার পাঠক সংখ্যা খুব একটা বেশী নয়…
    আমার একটা বাংলা ব্লগ আছে , নিতান্ত উপযাচক হয়ে লিঙ্ক দিলাম… সময় পেলে ঘুরে আসবেন… 😀

    https://nijermoneblogblog.wordpress.com/

    Liked by 1 person

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান